ঘটনাটা বেশ আগের। মফস্বল শহরের। স্থানীয় একটা পত্রিকায় কাজ করতাম। নিউজ আর ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবার দায়িত্ব ছিল হাতে। সে সময় নিউজ প্রকাশে সেল্ফ সেন্সরশিপ (নিজস্ব বিবেচনা বোধ) নিয়ে মাঝে মাঝেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো।
একদিন স্টাফ ফটো সাংবাদিক এলেন একটা ছবি হাতে। শহরের এক অভিজাত পার্কে বসে থাকা এক যুগলের ছবি। ছেলেটি তার মেয়েবন্ধুকে বেশ রোমান্টিক মুডে জড়িয়ে ধরে আছেন। ভালোই লাগছিল দৃশ্যটি দেখে! ভেতরে ভেতরে আফসোসও হচ্ছিল। জীবনের উদ্দাম সময় জুড়ে এমন দৃশ্যের সঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ আসেনি বলে!
ফটো সাংবাদিকের কথা, এসব দৃশ্য দেখে পরিবার নিয়ে তো আর পার্কে যাওয়া যায় না। এসব বন্ধ করা উচিত। আমি খানিকটা আপত্তি জানিয়ে বললাম, থাক না, ওরা তো সব কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। একটু আধটু ভালোবাসার চর্চা করতে দোষ কি? কি দরকার ছবি প্রকাশ করে ওদের বিব্রত করার?
এ কথা শুনে হঠাৎ করেই চেহেরা পাল্টে গেল ফটো সাংবাদিকের। ভেতরে খানিকটা ক্ষোভ পুষে রেখে বললো, ‘আচ্ছা ভাই, মেয়েটি যদি আপনার বোন হতো, আর এভাবে ক্লাস-পড়াশোনা ছেড়ে পার্কে বসে থাকতো, তাহলে কি মেনে নিতে পারতেন?’
ফটো সাংবাদিকের ওই প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খাওয়া ছাড়া কোনো উত্তর দিতে পারিনি। তবে ছবিটা পরদিন পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল।
গল্পটা মনে পড়েছিল, ঢাকা কমার্স কলেজে ‘প্রেমের প্রস্তাব’ দিতে বন্ধুদের ‘স্মরণীয় আয়োজনের’ খবর আর দৃশ্য (ভাইরাল হওয়া ভিডিও) দেখে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) এ নিয়ে প্রবল ঝড় বইছে। নচিকেতার ‘প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া এই দেশে অপরাধ, ঘুষ খাওয়া কখনই নয়…’ গানের কথা উল্লেখ করে অনেকেই স্ট্যাটাসের সুনামি বইয়ে দিচ্ছেন।
প্রবল অগ্রসর মননের একজন সংবাদকর্মীর (লেখিকা?) স্ট্যাটাসে দেখলাম বিষয়টি এসেছে অপেক্ষিক বিচার্যে। অর্থাৎ যেদেশে গোপন মহামারির মতো চলছে পরকীয়া, যৌন প্রতারণা, সেক্সট্যুর, ধর্ষণ উৎসব- সেখানে কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক (মূলত অপ্রাপ্তবয়স্ক) ছাত্র-ছাত্রীর নিষ্পাপ প্রেম অতিরিক্ত তো কিছু নয়। আর এ সামান্য ঘটনায় অন্যদের জ্বালা ধরে কেন, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। মূলত তিনি অতিউদারভাবে দেখার চেষ্টা করছেন ওইসব শিক্ষার্থীর প্রেমপ্রস্তাবের স্মরণীয় আয়োজনকে।
টিনএজ প্রেমের এমন দৃষ্টান্তের পক্ষে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া হাজারো স্ট্যাটাসে কমেন্ট করা কিন্তু অসম্ভব। তবে আমার এক সাবেক সহকর্মীর স্ট্যাটাসে হঠাৎ করেই চোখ পড়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘কেমন একটা আজব দেশে আছি রে ভাই। এদেশে ঘুষ খেলে কোনো অপরাধ হয় না। অপরাধ হয় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ভালোবেসেছে বলে।’
নেহাত পরিচিত বলেই তার স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে কমেন্ট করার (বলা যায় প্রশ্ন করার) লোভ সামলাতে পারলাম না। লিখলাম, ‘ওই দুজনের মধ্যে মেয়েটি যদি আমার সহোদর বোন হতো আমি নিশ্চিত, ঘটনাটা মানতে পারতাম না… শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রেমচর্চা করার অপরাধে গালমন্দ করতেও হয়তো ছাড়তাম না। আমরা কি দায় না নিয়েই বলছি এসব? তিরটা যদি নিজের দিকে নিক্ষেপ করি কেমন হয়…?’
প্রত্যুত্তরে (রিপ্লাই) আমার ওই সহকর্মী লিখলেন, ‘বড় ভাই হিসেবে এটা কীভাবে নিতাম সেটা এখন বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় ওরা স্কুল থেকে বহিষ্কারের মতো কোনো অপরাধ করেনি। প্রেম চর্চাই করেছে নিয়ন ভাই, কোনো সহপাঠীর দিকে কু-নজর ফেলেনি।’
আমি তার রিপ্লাইয়ের ‘বড় ভাই হিসেবে এটা কীভাবে নিতাম সেটা এখন বলতে পারছি না।’ বাক্যটি কোট করে থেমে গেলাম। বুঝলাম, আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন। যেমন পড়ে গেলেন আমার আরেক সহকর্মী। টিনএজ প্রেমের দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী ওই ঘটনায় তিনি মুগ্ধ। তবে যখন তাকে প্রশ্ন করা হলো, যার হাতে ওই কিশোর প্রেমিক আংটি পরালো সে যদি আপনার বোন হতো? এ প্রশ্নে তার মুখটা শুকিয়ে গেল। তিনি হয়তো বলতে চাইলেন, ‘না সেটা মানতে পারতাম না’।
আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটা অংশ আছে যারা নিজেদের প্রবল অগ্রসর মননের বলে দাবি করেন। সব ধরনের ভালোবাসাকেই (পরকীয়া, লিভটুগেদার..!) যৌক্তিকভাবে প্রবল সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করেন। পশ্চিমামূল্যবোধের মোড়কে নিজেদের ঢেকেও দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরাই টিনএজ প্রেমের ওই ঘটনার পক্ষে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের সাফ কথা, ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, পথে-ঘাটে যৌন হয়রানী, বখাটেপনা আর ধর্ষণের চেয়ে তো ভালো কাজটাই করেছে টিনএজরা।
মোরাল অব দ্য স্টোরিটা হচ্ছে, ‘আমরা পারিবারিক বা সামাজিক কোনো রকম দায় না নিয়েই ঘটনা বিষয়ে মন্তব্য করে যাচ্ছি।’
তবে ব্যতিক্রমও কিন্তু দেখা যাচ্ছে। আমার খুব কাছের একজন আছেন, যিনি প্রবল অগ্রসর মননের। ঘটনার পর থেকে নানা মন্তব্য দিচ্ছেন। তার সেসব মন্তব্যে আমি বিস্মিত, হতবাক। কারণ তিনি গণমাধ্যম আর সামাজিক সংস্কারের পক্ষে বিচরণ করা এদেশের গুরুত্বপূর্ণ নারীদের কাতারেই পড়েন। নিজেদের ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের এমন উৎসবমুখর প্রেমকে তিনি কিছুতেই সমর্থন করছেন না। যদিও নিরূপায়-নিপীড়িত নারীদের স্বাধীন জীবন যাপনকে যৌক্তিকভাবেই সবসময় তিনি সমর্থন করে আসছেন।
তার এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে বোধগম্য হচ্ছে, তিনি তার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ভাগ্নেকে নিয়েই ভীষণ টেনশনে পড়ে গেছেন। তার কলিজার টুকরা ভাগ্নেও কি এমন আয়োজন করছে তার ক্যাম্পাসে? তার টেনশন আরেক ভাতিজিকে নিয়েও, যে কিনা রাতদুপুরে প্রায়ই ফেসবুকে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকে।
মূলত, বাবা-মা কিংবা কোনো অভিভাবকই চাইবেন না, স্কুল-কলেজে পাঠানো তার ছেলে বা মেয়ে এমন সব কাণ্ড করে বসুক। ক্লাস, লেখাপড়া ছেড়ে অপ্রাপ্ত বয়সের প্রেমচর্চা করুক। আর বাবার কাছ থেকে চেয়ে নেয়া টাকায় আংটি কিনে তার কিশোরী প্রেমিকার হাতে পরিয়ে দিক।
পশ্চিমা লেখক মারজোরি রাওলিংয়ের ‘মাদার ইন মেনভিল’ পড়েছেন অনেকেই। গল্পের কিশোর জেরি ছিল মা হারা ছেলে। কিন্তু লেখক মারজোরিকে দেখে তার মায়ের কথা মনে পড়েছিল খুব। তাই সে মৃত মাকে লেখকের কাছে জীবিত হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে চমৎকার গল্প সাজিয়েছিল। তবে শেষ অবধি জেরির মায়ের সাক্ষাৎ না পেয়ে লেখিকার মনে হয়েছিল, ‘মানুষ বাস্তবে যা না পায়, কল্পনায় তা পাওয়ার চেষ্টা করে।’
গল্পটির অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক নয়। গ্লোবাইলাইজেশনের (বিশ্বায়ন) প্রভাব বলয়ে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে আমাদের প্রচলিত মূল্যবোধগুলো পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের সে মানসিক পরিবর্তন যতটা কল্পনায় ভাবা যায়, ততোটা বাস্তবে হয় না। মূলত কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ বা দর্শনে (আদৌ আছে কি?) আমরা এখন আর প্রভাবিত নই। আমাদের মূল্যবোধের পরিবর্তনের ডাকে সাড়া দেয়ার প্রক্রিয়াটা ব্যক্তি বিশেষের প্রয়াস (ইনডিভিজুয়াল) হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
এর অর্থ সেটাই- বাস্তবে আমরা যা পাচ্ছি না, কল্পনাতেই তা পাওয়ার চেষ্টা করছি।
তাই যদি কল্পনা করি, বাংলাদেশের কোনো এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে দশম বা একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র আরেক ছাত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়ার ঘটনা স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ আয়োজন করেছে। সে ঘটনা সবাইকে জানিয়ে দিতে কয়েকজন বন্ধু ভিডিওও ধারণ করলো। আর সে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে- ‘প্রথমে হাতে হাত ধরে বৃত্ত বানিয়ে ছাত্র-ছাত্রীকে ভেতরে রেখে চারপাশ ঘুরছে সহপাঠী-বন্ধুরা। এরপর ছাত্রটি হাঁটু গেড়ে ছাত্রীকে প্রপোজ করছে, পরিয়ে দিচ্ছে আংটিও। এরপর সেই ছাত্রী সম্মতি জানিয়ে ‘জয়ের আনন্দে’ একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। বাকি বন্ধুরাও উদযাপন করছে সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।’
এমন ‘অবিস্মরণীয় মুহূর্তের’ ভিডিওটি যখন সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে ছাড়া হচ্ছে তখন সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। সেই ‘অবিস্মরণীয় মুহূর্তকে’ নিয়ে বন্ধুরা কমেন্ট করছে, ‘হাউ সুইট, কত্ত রোমান্টিক একটা মোমেন্ট’!
এমন একটা দৃশ্যে নিজেকে কল্পনা করলে মুহূর্তেই রূপকথার রাজকুমার হয়ে যাই আমরা। পেয়ে যাই স্বপ্নের রাজকুমারীকে। যা শুধুই ফ্যান্টাসি।
লেখক: কান্ট্রি এডিটর, বাংলামেইল২৪ডটকম
পাঠকের মতামত